বেলজিয়ামের এঞ্জিসের কাছে অবস্থিত এক গুহা থেকে ১৮২৯ সালে একটি নিয়ান্ডারথাল শিশুর মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয়, যা ছিল নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির পাওয়া সর্বপ্রথম ফসিল। এরপর ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কের ফসিল অন্তর্ভুক্ত আছে। যদিও ১৮২৯ সালে নিয়ান্ডারথালদের প্রথম ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিল, তবুও ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকা থেকে আবিষ্কৃত ফসিলটিকেই নিয়ান্ডারথালদের আদর্শ ফসিল হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এই নিয়ান্ডার উপত্যকার নামানুসারেই এই প্রজাতিটির নামকরণ করা হয়েছে নিয়ান্ডারথাল।
বসতি স্থাপন ও দৈহিক গঠন
আমাদের সমসাময়িক ও প্রায় একই বৈশিষ্ট্যধারী নিয়ান্ডারথালদের বিকাশ ঘটেছিলো মূলত ইউরোপ এবং এশিয়াতে। আবিষ্কৃত ফসিলের গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুসারে নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে ইউরোপে। প্রখর অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রজাতিটি ইউরেশিয়া, পশ্চিম পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে সাইবেরিয়ার আলটাই পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। ঠাণ্ডা জলবায়ুতেও কয়েক লাখ বছর ধরে সফলভাবে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল তারা।
যেহেতু নিয়ান্ডারথালদের আবির্ভাব ঘটেছিল শেষ তুষার যুগে, তাদের দৈহিক গঠন ও জীবন যাত্রা ছিল শীতল আবহাওয়ার উপযোগী। তাদের মুখের কেন্দ্রীয় অংশটি সামনের দিকে প্রসারিত ছিলো। তাদের চেহারার মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নজরে পড়তো তা হল তাদের লম্বা এবং প্রশস্ত নাক। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ঠান্ডা এবং শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই তাদের চেহারার এইরকম বিশেষ ধরণের গঠন ছিল। তারা যে নিশ্বাস নিতো তা আর্দ্র এবং উষ্ণ করতে তাদের এই অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত নাককে কাজে লাগাত। তাদের ছোট হাত-পা সম্বলিত গাট্টাগোট্টা ধরণের শরীর ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাদের দেহের গড়ন ঠাণ্ডা পরিবেশে বসবাসের উপযোগী হলেও তাদের বিলুপ্তি ঘটল কেন! এমন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।
আরো প্রতিকূল হয়ে গেছে। ফলে দৈহিক সহনশীলতার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, যার সাথে তারা পেরে উঠেনি। খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্যও ছিল কম, ফলে অন্য কিছু খেয়ে বেঁচে থাকাটা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধু অত্যধিক ঠাণ্ডা পরিবেশই নয়, আরও অনেক ধরণের জলবায়ুগত পরিবর্তন কাবু করে ফেলেছিল নিয়ান্ডারথালদের। বলা যায়, জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে আচার-অভ্যাস ও খাদ্যাভ্যাসে যে ধরণের পরিবর্তন আনার দরকার ছিল, তারা তাতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আধুনিকদের সাথে টিকে থাকার প্রতিযোগিতা
নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তিতে জলবায়ুর প্রভাব তো ছিলই, পাশাপাশি আমাদের এও মানতে হবে যে হোমো স্যাপিয়েন্স তথা আধুনিক মানুষও তাদের বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করেছিল। কারণ তাদের বিলুপ্তির সূচনাই ঘটে আধুনিক মানুষ যখন আফ্রিকার ক্রান্তীয় পরিবেশ ছেড়ে ইউরোপে বসতি স্থাপন শুরু করে। শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। কিন্তু ঠিক কি কারণে আধুনিকরা টিকে থাকলেও প্রবল অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন নিয়ান্ডারথালরা পা বাড়াল বিলুপ্তির পথে? বিজ্ঞানীদের এ ব্যাপারে নানামত থাকলেও খাদ্যের প্রতিযোগিতা যে নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির একটি বড় কারণ তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
একে তো জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে নিয়ান্ডারথালদের আহার যোগ্য বড় বড় ম্যামথ, বল্গা হরিণ বা পাহাড়ী ভাল্লুকের বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। তার উপর এসে যুক্ত হল আধুনিক মানুষ। ফলে ভাগ বসল নিয়ান্ডারথালদের আহারে। এসব প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে থাকলে আধুনিক মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে অন্য উপায়ে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে থাকে। আর এই জায়গায় ব্যর্থ হয় নিয়ান্ডারথালরা। তারা নতুন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তারা ধীরে ধীরে ঢলে পড়ে বিলুপ্তির মুখে।
ক্যানিবালিজম
ক্যানিবালিজমকেও তাদের বিলুপ্তির একটি কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। ক্যানিবালিজম হল নিজ প্রজাতির মাংস খাওয়া। একসময় নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে এই ক্যানিবালিজমের চর্চা শুরু হয়। তারা যে নিজ প্রজাতির মাংস খেতো, তার প্রমাণ মিলেছে বেলজিয়ামের গোয়েত গুহা থেকে প্রাপ্ত মানুষের হাড়ে। এসব হাড় বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে নিয়ান্ডারথালরা শেষ পর্যায়ে নিজ প্রজাতির মাংস খাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। প্রাপ্ত হাড়গুলো নিয়ান্ডারথালরা যে সময় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছিল সে সময়ের। এমনকি এক পর্যায়ে তারা মৃতদেহ পর্যন্ত খাওয়া শুরু করেছিল। হয়তো পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব তাদের এ নিকৃষ্টতম কাজে বাধ্য করেছিল।
বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে তারা কতটা নিষ্ঠুরভাবে নিজ প্রজাতির মাংস খেতো তাও উঠে এসেছে। নিয়ান্ডারথালরা তাদের নিজ প্রজাতির হাড়গুলো এমনভাবে ভেঙেছে যেভাবে তারা ঘোড়া এবং হরিণের হাড় ভাঙতো। হাড় থেকে এমনভাবে মাংস বিচ্ছিন্ন করেছে যেভাবে ঘোড়া এবং হরিণের মাংস বিচ্ছিন্ন করতো। কিন্তু ঠিক কী কারণে তারা নিজেদের মাংস খাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল তা এখনো রহস্যের বিষয় বৈকি! তাদের বিলুপ্তিতে তাদের এই অতি আগ্রাসী জীবনযাপনও যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী।
তবে ঠিক কি কারণে নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়েছিল তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে আমরা সম্ভাবনার কাঁধে ভর দিয়ে ধারণা করতে পারি শুধু। কারণ প্রতিটি ফসিল আবিষ্কারের সাথে সাথে কোন বিষয়ে নিশ্চিত হলে আবার নতুন বিষয়ে সন্দেহের জন্ম হয়। হয়তো নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়নি, হয়তো তারা আমাদের পূর্বপুরুষ! কিংবা হয়তো তাদের বিলুপ্তির পিছনে আরো বড় কারণ আছে যা এখনো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। কোন বিষয়ই নিশ্চিত করে বলা যায় না আসলে। তবে যে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায় তা হল ইউরেশিয়ার সকল স্থানের নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তি এক কারণে হয়নি। তারা যেহেতু অনেক দল উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, ফলে তাদের বিলুপ্তিতেও স্থানভেদে আলাদা প্রভাব বিরাজ করেছিল। যেমন, ২৮,০০০ বছর আগে জিব্রাল্টার থেকে বিলুপ্তদের যে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি এটা নিশ্চিত। কারণ এখানে নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির বহু পরে আধুনিকদের আগমন ঘটেছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন