জুরাছড়ি খুব একটা পরিচিত জায়গা নয়। অনেকের কাছে রাঙামাটিতে বেড়ানোর জায়গা বলতে সুবলং ঝরনা, ঝুলন্ত সেতু কিংবা নৌকায় চড়ে কাপ্তাই লেকে এক চক্কর! অথচ কাপ্তাই লেকের কোলজুড়ে বসে থাকা জুরাছড়ির সৌন্দয’র পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষের হাতে তৈরি কৃত্রিম কোনো সৌন্দর্য এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি জুরাছড়ির পথেরও যে সৌন্দর্য, তা খুবই আলাদা। গত পর্বেই সেই গল্প শুনিয়েছিলাম।
হাঁটি হাঁটি পায়ে পাহাড়ে
নীলাভ লেক আর সবুজ পাহাড় বেষ্টিত জুরাছড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে যে কেউ। এমন দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ে সবসময় খুঁজে পাওয়া যায় বুনোগন্ধ আর নীরবতা। মোটরবাইক ভাড়া করে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, কিংবা নৌকা নিয়ে লেকের নীলাভ জলরাশির ওপর ভেসে চলা—সব মিলিয়ে অবর্ণনীয়।
প্রায় চার ঘণ্টা জলরাশিতে ভাসার পর ঘণ্টাখানেক হাঁটি হাঁটি পায়ে পাহাড় বাওয়াই যায়। নামহীন এই পাহাড়ে আমরা উঠছি উদ্দেশ্য নিয়েই। প্রথমে মনে হয়েছিল খুব সহজেই ওঠা যাবে এ পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু এর ওঠার পথ বেশ খাড়া। ভেজা শরীরেও ঘাম ঝরতে লাগল তরতর করে। ক্লান্ত লেক-নদী ছুঁয়ে আসা বাতাসের প্রবাহ পাহাড় বেয়ে ওঠার কাজটিকে কিছুটা হলেও সহজ করে দিল।
৫০ মিনিটের মতো ট্রেকিং করে উঠে পড়লাম পাহাড়চূড়ায়। উঠতে উঠতে দেখছিলাম দূরের ঢেউখেলানো পাহাড় সারি। যেন অন্য রকম শৈল্পিক রূপ ধারণ করেছে এখানে। একপাশে প্রশস্ত কাপ্তাই লেকের বুকে ছোট-বড় দ্বীপপুঞ্জ। আরেকপাশে সমতল ভূমিতে মানুষের ঘরবাড়ি। এর আশেপাশে সারিবদ্ধ নারিকেল, গর্জন ও জারুল গাছের হাতছানি উপেক্ষা করার মত নয়। যতই তাকিয়ে থাকি, মুগ্ধ হই!
দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি
এই পাহাড়ের চূড়াতে শুভলং শাখা বন বিহারে সাধনানন্দ মহাস্থবীর (বনভান্তে) কমপ্লেক্স। সেখানেই নিমির্ত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি। অনেকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায়ও এরচেয়ে বড় ‘শুয়ে থাকা’ বুদ্ধমূর্তি নেই। ১২৬ ফুট সিংহশয্য গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটির এখনও অনেকখানি কাজ বাকি।
বিহার কর্তৃপক্ষ জানায়, এত বড় ধ্যানরত বুদ্ধমূর্তি দেশে এই প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও এরচেয়ে বড় শুয়ে থাকা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি আছে কি-না জানা নেই। ২০১৬ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এলাকাবাসীর উদ্যোগে কায়িক শ্রমে বুদ্ধমূর্তিটির ঢালাই দেয়া হয়। সেসময় দূর-দুরান্ত থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী অংশগ্রহণ করেন।
জানা গেছে, বুদ্ধমূর্তির শরীরের রঙ হবে সোনার রঙের। থাইল্যান্ড থেকে আনা হবে বুদ্ধমূর্তির চোখ ও রঙ। দেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তিটির স্থপতি বিশ্বজিৎ বড়ুয়া, পওতিপদ দেওয়ান ও দয়াল চন্দ্র চাকমা। এটির প্রধান প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমা ও ডিজাইন করেছেন ভদন্ত বিমলানন্দ স্থবির।
পুরো কমপ্লেক্সটি ঘোরার পর সরাসরি ঘাটেই যেতে হবে। সেখান থেকে জুরাছড়ি ঘাটে যাওয়ার একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল। বলে রাখা ভালো, জুরাছড়িতে যাতায়াতের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম মোটরসসাইকেল। সিএনজি নামে পরিচিত অটোরিকশাও দেখতে পাবেন; তবে সংখ্যায় খুবই কম ও ব্যয়বহুল।
জুরাছড়ি রাতযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ফিরতে হবে। লঞ্চে বসে আবার রওনা হলাম রাঙামাটির পথে। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, দুর্গমতা কীভাবে ঢেকে রাখে তার প্রকৃতির গোপন সৌর্ন্দয্য! এই সৌন্দর্যের নিবিড় ডাকে সাড়া দিলে জীবনটা হয়ে উঠবে উপভোগ্য!
যাওয়া ও থাকা
জুরাছড়িতে রাঙামাটি হয়েই যেতে হয়। রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে লঞ্চ করেই জুরাছড়ি যেতে হয়। সারাদিনে মাত্র দুটো লঞ্চ জুরাছড়ি আসা-যাওয়া করে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে ও দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আরেকটি লঞ্চ জুরাছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফেরার লঞ্চের সময়- দুপুর দেড়টা ও রাত সাড়ে ৮টা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
যেহেতু পুরো জার্নিটাই নৌপথে, লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেয়া ভালো। যদি সাঁতার না জানেন তবে পানিতে নামবেন না। যাত্রাকালে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখবেন। জুরাছড়ি দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে। এক রাত যদি থাকতেই চান, তাহলে খাবার হোটেলের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সম্ভব হলে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে যাবেন। লেকের পানি খুবই স্বচ্ছ ও নীলাভ। পানিতে কোনো বোতল, প্যাকেট বা প্ল্যাস্টিক ফেলবেন না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন