বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের ও আবু সালেক এর রোমহর্ষক বীরত্বের গল্প
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ এসেছিল আকস্মিকভাবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই তুলনায় এপ্রিল এসেছিল অনেকটা ধীরে। প্রতিটি দিন একটু একটু করে মানুষের কাছে পরিষ্কার হচ্ছিল – স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ, দখলদার বাহিনীর আক্রমণ শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ কী!
এপ্রিলের ইতিহাস ছিল ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরেও পাক বাহিনীর আক্রমণের ইতিহাস। বিমান হামলা, এলোপাথাড়ি গুলি, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণের ইতিহাস। গণহত্যা থেকে বাঁচতে লক্ষ লক্ষ মানুষের দেশ ছেড়ে পালানোর ইতিহাস। শিশুদের কোলে নিয়ে, বৃদ্ধ বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদী, নানা-নানীদেরকে কাঁধে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর ইতিহাস। কিন্তু একইসাথে এপ্রিল ছিল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শেখারও ইতিহাস। নিজেকে নতুন করে চেনার ইতিহাস। দেশের মুক্ত অঞ্চলগুলোকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইতিহাস।
২৬শে মার্চ থেকেই বাঙালি পুলিশ এবং সেনারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল। এপ্রিলের শুরুতে গিয়ে তাদের সেই যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে উঠছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রথম দিনগুলোতে সবচেয়ে সফল প্রতিরোধের ঘটনাগুলো ঘটেছিল চট্টগ্রাম এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে। অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জেনারেল এমএজি ওসমানী এবং মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে গিয়েছিল চট্টগ্রামের দিকে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীরউত্তম।
ক্যাপ্টেন কাদেরের কর্মস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের হায়দ্রাবাদে। ‘৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার বাড়িতে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। ১৯ ফেব্রুয়ারি কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে কোর্টে গিয়ে বিয়েও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এক মাস পরেই যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন নববিবাহিতা স্ত্রীর আকর্ষণ তার কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। চাকরিতে ফিরে না গিয়ে দেশকে মুক্ত করার জন্য তিনি বেরিয়ে পড়েন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
সে সময় কালুরঘাটসহ চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে চলছিল তুমুল যুদ্ধ। সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর রামগড় ছিল তখনও নিরাপদ, কিন্তু কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন কাদের রামগড়কে শত্রুমুক্ত রাখার জন্য স্থানীয় স্বাধীনতাকামী যুবক ও তরুণদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তার নেতৃত্বে একের পর সফল অভিযানের মাধ্যমে পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা শ্লথ হয়ে পড়ে।
কালুরঘাটের পতনের পর অষ্টম ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় মহালছড়িতে। ফলে পাকিস্তানিদের পরবর্তী আক্রমণের প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠে মহালছড়ি। পাকিস্তানিরা স্থানীয় মিজো উপজাতিদেরকে নিজেদের দলে টানতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ১ কোম্পানি সৈন্য এবং প্রায় ১,০০০ সদস্যের মিজো ব্যাটালিয়ন মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। বিপরীতে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল একেবারেই নগণ্য, তাদের অনেকেরই কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। এর মধ্যে পাকবাহিনী হেলিকপ্টারযোগে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সৈন্য নামিয়ে দিয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন কাদেরের দলটি প্রথমে অন্য দায়িত্বে ছিল, কিন্তু সঙ্গীদেরকে রক্ষার জন্য দুপুরের দিকে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে উপস্থিত হয়। তাদের সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথমে পিছু হটতে শুরু করে। কিন্তু বেপরোয়া পাকসেনারা পেছন থেকে অস্ত্র ধরে মিজোদেরকে পুনরায় সামনে অগ্রসর হতে বাধ্য করলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে। সামনে-পেছনে দুদিক থেকেই হুমকির সম্মুখীন হয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মিজোরা। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে চারপাশ থেকে মুক্তিবাহিনীকে প্রায় ঘিরে ফেলে।
পরিস্থিতি অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে সহযোদ্ধারা পশ্চাদাপসরণের পরামর্শ দেন ক্যাপ্টেন কাদেরকে। কিন্তু পিছু হটতে রাজি ছিলেন না ক্যাপ্টেন কাদের, অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
শত্রুবাহিনী তাদের ২০০ গজের মধ্যে চলে আসে, এমন সময় হঠাৎ মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর মেশিনগানটি অচল হয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে ক্যাপ্টেন কাদের নিজের জীবন বিপন্ন করে সামনে এগিয়ে যান। নিজের এলএমজি দিয়ে শত্রুর উপর ক্রমাগত ফায়ার করতে শুরু করেন। তার আক্রমণে মিজো বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে যায়, আর এই সুযোগে তার সহযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরন করতে সক্ষম হয়। সামলে নিয়ে পাক বাহিনী আবার এগিয়ে আসতে শুরু করলে তাদের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন কাদের। একে একে ৪টি গ্রেনেডে পাকিস্তান বাহিনীর ৪টি বাংকার বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু পঞ্চম গ্রেনেড ছোড়ার সময় বিপরীত দিক থেকে শত্রুর এসএমজির কয়েকটি বুলেট এসে তার বুক ভেদ করে চলে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায়ও হাত থেকে অস্ত্র ছাড়েননি কাদের, কিন্তু একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার সাথে শেষপর্যন্ত থেকে সহযোদ্ধার কয়েকজন আহত অবস্থায় তাকে জীপে তুলে রামগড়ের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু গুইমারায় এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
সেদিনের যুদ্ধে শেষপর্যন্ত মহালছড়ি মুক্তিবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুঃসাহসী বীরযোদ্ধা ক্যাপ্টেন কাদেরের আত্মত্যাগের কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা। বিপরীতে এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষ জয়ী হলেও তাদের হতাহতের পরিমাণ ছিল ব্যাপক। মিজো ব্যাটালিয়নের প্রায় ৪০০ সৈন্য এবং পাকবাহিনীর কমান্ডো কোম্পানির ৪০ জনের মতো সৈনিক হতাহত হয়েছিল সেদিন।
এপ্রিল মাসটি শুধু যুদ্ধের জন্যই না, যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণের জন্যও ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেই মুক্তিপাগল লক্ষ লক্ষ যুবক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ছুটে গিয়েছিল ভারতের উদ্দেশ্যে। শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য না, বরং প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে দেশকে মুক্ত করার জন্য। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবার ১৪ বছর বয়সী কিশোর আবু সালেক। সে সময় তিনি সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছিলেন।
২৬ মার্চের পর থেকেই আবু সালেক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাবা-মাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এত অল্প বয়সী ছেলেকে হাতছাড়া করতে তারা রাজি ছিলেন না। উপায় না দেখে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । ৩০ এপ্রিল রাতের অন্ধকারে এক চাচার সাথে তিনি গোপনে ভারতে পালিয়ে যান।ভারতের আগরতলায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। আবু সালেকও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। কিন্তু বয়স কম বলে শুরুতেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাকে। তবে বাদ পড়ার জন্য তিনি এত দূর থেকে ছুটে আসেননি। তিনি কান্না জুড়ে দেন, চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। শেষপর্যন্ত তার জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় সবাই।
তার স্থান হয় মেলাঘরে দুই নম্বর সেক্টরের ৪ বেঙল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রচালনা আয়ত্ত্ব করে তিনি নাম লেখান মুক্তিযোদ্ধাদের খাতায়। যুদ্ধ করার জন্য ফিরে যান তার নিজের এলাকা কসবায়।
আবু সালেক এবং তার সঙ্গীরা প্রায়ই একসাথে দশজন করে অপারেশনে বেরুতেন। অতর্কিতে দশটি অস্ত্র দিয়ে একসাথে পাকিস্তানিদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করতেন, এরপর তারা গুছিয়ে ওঠার আগেই আবার ফিরে আসতেন।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন তারা কসবা হাই স্কুলের পাশে চন্দ্রাপুর গ্রামে অবস্থান নেন। সেদিন মধ্যরাত থেকে শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাকিরা যেন নিরাপদে পালাতে পারে, সেজন্য একজনকে পেছনে থেকে যেতে হয়। তার কাজ ছিল কভারিং ফায়ার করে শত্রুপক্ষকে ব্যস্ত রাখা এবং সঙ্গীদেরকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া। সহযোদ্ধাদেরকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত জীবন বাজি রেখে পেছনে রয়ে যান কিশোর আবু সালেক। নিজের সরু কাঁধে তুলে নেন পাহাড়সম দায়িত্ব। অনবরত গুলি চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। তার ক্ষিপ্র আক্রমণে পাকিস্তানিদের ধারণা হয়েছিল, সেখানে মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি আছে। তারা আর সামনে এগোনোর সাহস না করে পেছনে ফিরে যায়।
ভোরের দিকে দুই পক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসেন। আবু সালেকের সাড়া না পেয়ে তারা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো শাহাদাত বরণ করেছেন। কিন্তু বাঙ্কারে গিয়ে তারা দেখতে পান, রাতভর গুলি চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে কিশোর আবু সালেক বাঙ্কারের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দলের যোদ্ধাদের জীবন বাঁচানো এই বীর কিশোর যোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানেই জড়িয়ে ধরেন। কেউ কেউ তাকে স্যালুট দিয়েও সম্মান জানান। স্বাধীনতার পর আবু সালেককে বীর প্রতীক উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
সামগ্রিকভাবে এপ্রিল মাসে মুক্তিবাহিনীর সফলতার গল্প ছিল কম। তাদেরকে হয়তো আবু সালেকের মতো ভারতে চলে যেতে হয়েছিল প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য, অথবা পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছিল মহালছড়ি যুদ্ধের মতো। কিন্তু এই মাসে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের মতো বীরত্ব, সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের গল্পগুলো বাকি আট মাস ধরে অনুপ্রাণিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। পরবর্তীতে হাজার হাজার আবু সালেক যখন প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন উদ্দীপনায় ফিরে আসে দেশকে মুক্ত করার জন্য, তখন তাদের সামনে বিজয়ই ছিল একমাত্র সম্ভাব্য ফলাফল। আর তাই মহালছড়ির যুদ্ধ এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন