শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে লোকটির প্রাপ্য টাকা থলে ভরে নিজেই নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম শিবরাম চক্রবর্তী!
এই পরিচয়টি বহুদিন সাহিত্যের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে সিনেমাপাড়ার লোকেরা বলে বেড়াতো। শিবরাম যেভাবে অন্তরালে থাকতে পছন্দ করতেন, সে হিসেবে মানুষ হিসেবে তাকে চেনাতে হলে এরকম পরিচয় ছাড়া কিইবা বলা চলে। সত্যি বলতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিবরাম চক্রবর্তী ক্ষমা করতে পারেননি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
অথচ একসময় শরৎবাবুকে শ্রদ্ধা করতেন অনেক। নিজের বইয়ের ভূমিকা লেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের কাছেই। লিখে দেয়ার পর সেই শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু একটি ঘটনা পুরো ব্যাপারটিকেই পাল্টে দিলো।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। এ কথা সবাই জানতো। অথচ সেই নাটক যখন ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেখানে নাট্যকারের নাম বদলে শরৎচন্দ্রের নাম! শিবরামের বদলে শরৎবাবুর নাম দিলে পত্রিকা বিক্রি হবে বেশি। সম্পাদকের যুক্তিতে চুপ থাকলেন শিবরাম।
নাটক নিয়ে গেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কাছে। নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত নাট্যাচার্য। শুরু হল শো। প্রায় প্রতিদিনই হাউসফুল।
এদিকে তখন দেনার দায় জর্জরিত খোদ নাট্যকার শিবরাম।
নাটকের বেনিফিট শোয়ের দিন শিবরামকে আসতে বললেন শিশির কুমার। গেলেন। শো শেষে সাজঘরে গিয়ে হাত পাততেই শিশিরকুমার বললেন, ‘দেরি করে ফেললেন। আজ টিকিট বিক্রির সব টাকা একটি থলেতে ভরা ছিল, শো শেষ হতেই শরৎবাবু সাজঘরে এসে সব টাকা নিয়ে চলে গেলেন’।
পরে শিবরাম জানতে পারেন, শরৎচন্দ্র বলেছিলেন যেহেতু তার নামে নাটক চলেছে তাই এই নাটকের আয় তারই প্রাপ্য। যদিও শিশির কুমার তার নিজের একাউন্টে থাকা একশো বিশ টাকা শিবরামের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের মত শরৎবাবুর উপর থেকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন শিবরাম। এই পরিচয়ের এই হলো কাহিনী।
রসের ভান্ডার—লেখায় ও জীবনে
ব্যক্তিজীবনে অভাব অনটনে ছিলেন ঠিকই কিন্তু জীবনটা ছিলো তার সত্যিকারের রসবোধের। সে কথায় পরে আসছি। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখায় রম্য এক দুনিয়া ছিলো। যেই দুনিয়ার হাস্যরস খানিকটা আলাদাই। যেহেতু তিনি নাম করার জন্য লেখক হতে আসেননি, তাই লেখালেখিতে আক্ষরিক অর্থে ‘সিরিয়াস’ ছিলেন না। কিন্তু তার লেখায় পাওয়া যায় গভীর সময় ধারণ করার ইশারা। হাসির গল্প তিনি বলেছেন ঠিকই, তবে সনাতন পদ্ধতিতে গল্প বলার ভঙ্গিমা তাকে চিরায়ত করে রেখেছে সবার মাঝে।
শিবরাম চক্রবর্তীর ‘কাজির বিচার যাকে বলে’ ছোটগল্প খুললে আমরা দেখি, চোরের চুরি করতে গিয়ে চোখ খোওয়া যাওয়ার কারণে নালিশ দিতে এসেছে স্বয়ং চোর। তাই গৃহস্থের চোখও উপড়ে নেয়া হবে।
পুরো গল্পজুড়ে হাস্যরসের ছড়াছড়ি হলেও আদতে দেখতে পাই সময়কে ধারণ করার মস্ত এক ফাঁদ। যার মাথায় জুড়ে দেয়া হয়েছে হাসি। শিবরাম চক্রবর্তী ব্যক্তি জীবনে স্বদেশী আন্দোলন করেছেন। রাজনৈতিক সচেতনতা তার হাস্যরসের গল্পের মধ্যেও উঁকি দিতে দেখা যায়।
সমাজের সঙ্গে খানিকটা স্যাটেয়ার ভঙ্গিমায় কথোপকথন করতেও দেখা যায়। একজন ব্যক্তির হাঁস চুরি যাওয়ায় স্বাক্ষী সহ হাতেনাতে ধরে এনেছে হাঁসের চোরকে। কাজী হাঁস চোরকে শাস্তি দিলেন বৈকি। কিন্তু স্বাক্ষী কিংবা বিচারপ্রার্থী বাদ যাবে কেন?
তারপরে তিনি অভিযোগকারীকে ডাকলেন-
“তোমার অমনযোগিতার জন্যই হাঁসটা বেঘোরে মারা পড়ল। হাঁস চুরি করানোর অপরাধে তোমারও দশ মোহর জরিমানা আর দশদিন ফাটক।”
আসামী ফরিয়াদীর সুব্যবস্থা করে অবশেষে তিনি সাক্ষীর প্রতি ন্যায়-দৃষ্টিপাত করলেন–
“আর বাপু স্বাক্ষী! তুমিও লোক খুব সুবিধের নও। নিজের কাজে মন না দিয়ে কোথায় কে, কি করছে সেদিকে মন দেওয়ার তোমার কী দরকার? অতএব নিজের কাজে গাফিলতি করার জন্য তোমারও ঐ শাস্তি। দশ মোহর জরিমানা আর দশদিন ফাটক।”
আগেই বলেছি, লেখায় ছটাক ছটাক হাস্যরস ছড়িয়ে দেয়া এই লেখকের জীবন কিন্তু অভাব অনটনে থাকলেও বেশ মজার ছিলো। তিনি নিজের নাম শিবরাম চক্রবর্তীকে মজা করে বলতেন ‘শিব্রাম চকরবরতী’। ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা নামে আত্মস্মৃতিচারণামূলক একটা বই আছে তাঁর। কিংবদন্তি এই রম্য লেখকের অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে দেখা হয় এই বইটাকে।
শিবরামীয় তিন অভ্যাস—
সেটা পড়লেই বোঝা যায়, শুধু যে মজা করেছেন তা নয়, শিবরামের জীবনযাপনের ধরনই ছিল অন্য রকম। সেখানে বারবার এসেছে শিবরামের তিনটি অভ্যাসের কথা।
প্রথমটি হলো, খাওয়া। খাওয়া মানে একদম খেতেই থাকা। দ্বিতীয়টি ছিলো ঘুম। যখন তখন বিশাল নিদ্রা যাপন করা ছিলো ‘সুখী’ শিবরাম চক্রবর্তীর এক অন্যতম অভ্যাস। আর তৃতীয় অভ্যাসটি হলো, সিনেমা দেখা। অভাবে থাকলেও পকেটে শেষ কিছু টাকা থাকা পর্যন্ত রাতের বেলার সিনেমার টিকেটটি তার কাটা হতো। এ বিষয়ে কিছু মজার গল্প করা যাক।
লাখ টাকার মামলা করে বিশ্বভ্রমণ!
পুরো জীবনটাই তার কাছে ছিলো ঠাট্টা। টাকার পেছনে কখনই ছোটেননি শিবরাম। একবার সিনেমা দেখতে গিয়ে সিনেমাহলের মধ্যেই আচমকা পরিচয় হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে। খানিক সময়ের পরিচয় হলে কী হবে, স্বভাবমত পুরো সম্পর্ক জমিয়ে ফেললেন। পরিকল্পনা করতে বসলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পৃথিবীর কোন কোন দেশে তিনি ঘুরবেন। সিনেমা হলের সিটে বসে তিনি ঘুরে এলেন বিলেতের বহু জায়গা।
হুট করে বেরসিকের মত শিবরামকে থামিয়ে দিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিন্তু এত দেশ যে ঘুরব দু’জনে টাকা কই?
শিবরাম চক্রবর্তী খানিকটা বুক উঁচু করে বললেন সে চিন্তা করার কোন দরকার নেই। কারণ তিনি ইতোমধ্যে এক লাখ টাকার একটি মামলা ঠুকেছেন। সেই মামলায় জয়লাভ করলেই তো হয়ে যাবে। ‘আরে লাখ টাকার মামলা ঠুকেছি ভায়া। জিতলাম বলে। ওই টাকা হাতে পেলেই বেরিয়ে পড়ব দুই বন্ধুতে’।
লাখ টাকার মামলা সত্যিই করেছিলেন শিবরাম। নিজের পৈত্রিক সম্পত্তির উপর। উকিল-ব্যারিস্টারের ধার ধারেন না শিবরাম। এই মামলায় শিবরামের পক্ষের কোন উকিল নেই। কোন প্রামানাদিও নেই। সবকিছুই শিবরাম একাই। যাকে বলে ‘শিব্রামীয় মামলা’। কিন্তু একজন স্বাক্ষী আছে। আর সেই সাক্ষী কে? যার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন স্বয়ং তাকেই নিজের পক্ষের সাক্ষী বানিয়েছেন শিবরাম। এতই বিশ্বাস যে সাক্ষী মিথ্যে বলবেনই না।
এ দিকে যা অবশ্যম্ভাবী, তাই-ই ঘটল।
আদালতে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিপক্ষ তথা সাক্ষী বলল, ‘ধর্মাবতার শিবরামবাবুর এই অভিযোগ সবটাই মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন’। ব্যস, সাক্ষীর একটি কথাতেই পুরো মামলা ডিসমিস।
এরকম অসংখ্য অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন শিবরাম চক্রবর্তী। স্বয়ং সুভাষ চন্দ্র বসু চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন শিবরামকে। কিন্তু আদতে কি তিনি চাকরি করতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত? এই ঘটনাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো বেশ কয়েক বছর আগে।
চাকরিতে বরখাস্ত হয়ে ফেললেন স্বস্তির নিঃশ্বাস!
একবার বেজায় অর্থসংকটে শিবরাম। খবর কানে গেল দেশবন্ধুর। শিবরাম চিরকালই তাঁর বড় প্রিয়। বারবার বলতেন, শিবরাম আলাদা জাতের; অনেক প্রতিভা।
দেশবন্ধু চিঠি লিখলেন সুভাষ বোসকে— ‘শিবরামকে আত্মশক্তি কাগজে নিয়ে নাও। ভালো লেখে ও।’
গুরুদেবের আদেশে শিবরামকে চাকরিতে নিলেন নেতাজি। কিন্তু মানুষটি যে শিবরাম! নিয়মকানুনের ধারে কাছে নেই। কোনও দিন অফিস যান তো কোনও দিন টিকিটি নেই। কখন আসেন আর কখন বেরিয়ে যান তা’ও কেউ জানে না।
সুভাষ বোসের কানে গেল সেকথা। এমন আচরণ নিয়মনিষ্ঠ নেতাজির কোনও মতেই পছন্দ নয়। শিবরামকে ওয়ার্নিং তিনি দিলেন ঠিক সময়ে রোজ দপ্তরে আসার জন্য। কিন্তু শিবরাম কোনও দিনই বা কার কথা শুনে চলেছেন? ফলে যা হওয়ার তাই হল। একদিন হাতে একটি খাম পেলেন। তার মধ্যে একশো টাকার একটি নোট আর সুভাষচন্দ্রের একটি একলাইনের চিরকুট। তাতে লেখা।— ‘আপনাকে আর দরকার নেই।’ চাকরি নেই। এ বার দিন চলবে কী করে? ভয়ে তো কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু তিনি যে শিবরাম।
হাতে বরখাস্ত হওয়ার চিঠি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন!
শিবরামের জনপ্রিয় দুই চরিত্র
শিবরাম সৃষ্ট দুটি জনপ্রিয় চরিত্র হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন। ঘুরেফিরে বারবার বিভিন্ন গল্পে দেখা পাওয়া যায় তাদের। ‘হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন’, ‘হর্ষবর্ধনের হজম হয় না’, ‘হর্ষবর্ধন এক ডজন’, ‘হর্ষবর্ধন এবারো বারো’, ‘হর্ষবর্ধনের ভাত হজম’, ‘হর্ষবর্ধন হতভম্ব’, ‘হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার’, ‘হর্ষবর্ধনের মানসিক শোধ’, ‘দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনা’, ‘গোবর্ধনের কেরামতি’, ‘চোর ধরল গোবর্ধন’—এগুলো পড়লে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে হয় বলা চলে।
শিবরামের বেশির ভাগ লেখাই এমন ব্যঙ্গ-রসাত্মক। তবে ছোটদের জন্য লেখার সংখ্যাও অনেক। শিবরামের কিশোর উপন্যাস বাড়ি থেকে পালিয়ে নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক।
আজও তিনি ‘ফার্স্টক্লাস’
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা বড়-ছোট উভয় বয়সীদের মাঝেই টিকে আছে। ঠিক যেভাবে মৃত্যুর ৫ মিনিট আগে ‘ফার্স্টক্লাস’ আছি বলে চলে গিয়েছিলেন শিবরাম। পশ্চিমবঙ্গে তার বাড়ি মুক্তারামে ঢুঁ মারলে আজও দেখা মেলে সেকালের শিশুদের সঙ্গে, যাদের জানালা দিয়ে চিনি রুটি দিতেন শিবরাম দাদাবাবু নামের কেউ একজন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন