-->
927V0MJku1OcBLTuD7lkELe7Mk4OHfuDB8LuA1nI
Bookmark
বই রিভিউ, বই সংক্রান্ত নানান আলোচনা, সাহিত্য সমালোচনা, সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীসহ বিশ্বের আলোচিত-সমালোচিত নানান বিষয়ে Page Pleasure Books প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাঠকের জ্ঞানের জগৎ সমৃদ্ধ করাকে একটি সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করি। ‘Page Pleasure Books’ সেই দায়িত্ববোধ থেকেই নেয়া একটি প্রয়াস। বইয়ে বইয়ে সয়লাব হোক ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।

কাজী নজরুল ইসলাম এর রসবোধ !

কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪শে মে, ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্রোহী কবি নামেই বেশ সমাদ্রিত তিঁনি। পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির খেতাব। তাঁর কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

বাঙালি কবিদের মধ্যে নজরুলকে ধরা হয় সবচেয়ে রসিক। তাঁর কথায় কথায় হাসির ঢেউ উঠতো। হিরন্ময় ভট্টাচার্য তো ‘রসিক নজরুল’ নামে একটি বইও রচনা করেছেন। কেমন ছিল তাঁর রসবোধ? জেনে নিন-


বেশ্যাসক্ত

একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল মজা করে বললেন, ‘না, বেশ্যাসক্ত।’ ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। নজরুল তক্ষুণি ব্যাখ্যা করলেন, ‘পান একটু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত = বেশ্যাসক্ত।

বিড়ালভীতি

কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার সিরাজগঞ্জে সাহিত্যিক আসাদউদৌলা সিরাজীর আমন্ত্রণে বেড়াতে গেছেন। দুপুরের খাবারে সিরাজী নিজেই ইলিশ মাছ ভাজা দিচ্ছেন সবার পাতে। কবিকে এক টুকরো ইলিশ দিতে গেলে কবি বাধা দিয়ে বলেন, ‘আরে আরে করছো কী, আমারে অত্তো ইলিশ দেবে না। শেষকালে বিড়ালে কামড়াবে যে।’ সবাই অবাক। কবি বললেন, ‘ইলিশের গন্ধ মুখে লালা ঝড়ায়। বিড়াল সেই ঘ্রাণে হয় মাতাল। বেশি খেলে যে সারা দেহ হতে গন্ধ ছড়াবে। আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।’


খুকী ও কাঠবেড়ালী

পুতুলের মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে অঞ্জলি। একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো অঞ্জলির ওপর। তিঁনি দেখলেন, একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে বাচ্চামেয়েটি যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। সেকী কথা! কথা আর শেষই হতে চায় না। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে অঞ্জলি পেয়ারা চাইছে। কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না। নজরুল তো ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তিঁনি ভাবলেন, অঞ্জলির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। ছেলেটা দেয় তো ভালো। না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, অঞ্জলির সামনে গিয়ে কবি নজরুল গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তবে অঞ্জলি কথা বলছিলো কার সঙ্গে? নজরুল তখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’ অঞ্জলি বললো, ‘কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।’ কাঠবেড়ালীর সঙ্গে অঞ্জলির এই মান অভিমানের ঘটনাটি নজরুলকে এতোটাই চমৎকৃত করলো যে, এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতা-

‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও?

বাতাবি লেবু? লাউ?…’


হাসি

একবার কাজী নজরুল ইসলাম কে তাঁর বন্ধুরা খুঁজছেন। এ বাড়ি ও বাড়ি খোঁজা হচ্ছে। হঠাৎ দূরের কোন বাড়ি থেকে অট্টহাসির শব্দ কানে আসতেই নজরুলের খোঁজ মিলল। এমনই ছিল নজরুলের হাসির সুনাম। নিজের হাস্যরসপূর্ণ চরিত্রকে নজরুল নিজেই তুলে ধরেছেন একটি হাসির গানে-


‘আমি দেখব হাসি


আমায় দেখলে পরে হাসতে হাসতে পেয়ে যাবে কাশি।


আমি হাসির হাঁসলী ফেরি করি এলে আমার হাসির দেশে


বুড়োরা সব ছোঁড়া হয়, আর ছোঁড়ারা যায় টেঁসে


আমার হাস-খালিতে বাড়ি, আমি হাসু-হানার মাসি।


নিচে নামা

কাজী নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। একদিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’ এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?


নতুন জামাই

পাড়ায় নতুন জামাই এসেছে। নজরুল বন্ধুদের নিয়ে ফন্দি আঁটলেন জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা খসাতে হবে। তিনি জামাইকে গিয়ে বললেন, ‘নতুন জামাইদের দরমা পীরের দরগায় যেতে হয়। চলুন। নইলে অকল্যাণ হবে।’ নজরুলের বুদ্ধিতে একটা পোড়ো বাড়ির মধ্যে ‘দরমা ঘর’ আগে থেকেই লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হলো। জামাই সেখানে গিয়ে সালাম করে নগদ সালামি দিলেন। অথচ ‘দরমা’ মানে হলো হাঁস-মুরগির ঘর। যাহোক, এবার বন্ধুরা মিছিল করে জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত হলো। গেটে দাঁড়িয়ে নজরুল ছড়া কাটতে শুরু করলেন-


মাসি গো মাসি


তোমার জামাইয়ের দেখ হাসি


দরমা পীরে সালাম দেওয়ালাম


খাওয়াও মোদের খাসি।


দুই পেয়ালা চা

কবির এক বন্ধু ছিল। নাম শৈলেন। কবি তার কাছ থেকে কেবল চা খেতেন। চা খাওয়ার জন্য প্রতিদিন নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতেন। একদিন আর কোন ফন্দি-ফিকির না পেয়ে তিনি শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু’পেয়ালা চা দাও।’ শৈলেন তো অবাক! এ আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওয়ার সঙ্গে দু’পেয়ালা, মানে দুই কাপ চায়ের কী সম্পর্ক? তিনি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দু’পেয়ালা কেন?’ কবি বললেন, ‘আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনও দু’পেয়ালা বাকি আছে।’

গজল

শিল্পী আব্বাসউদ্দিন একদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন। আব্বাস উদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন। নজরুল বললেন, ‘কী? তাড়া আছে? যেতে হবে?’ আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিস্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। জোহরের নামাজ শেষ করার সাথে সাথে নজরুল আব্বাস উদ্দিনের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল।’ আব্বাস উদ্দিন বিস্ময়ের সাথে দেখলেন তার নামাজ পড়তে যে সময় লেগেছে ঠিক সেই সময়ের মধ্যে নজরুল সম্পূর্ণ একটি নতুন গজল লিখে ফেলেছেন। সেটিই হচ্ছে বিখ্যাত সেই গজল-


‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ


দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ।…’


টক দই

একবার কাজী নজরুল ইসলাম গেছেন সিরাজগঞ্জে, আসাদ উদ্দৌলা সিরাজীর বাসায়। খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে দই দেয়া হলো। কিন্তু সেই দই খুবই টক ছিল। আর তা খেয়ে নজরুল আসাদ উদ্দৌলার দিকে তাকিয়ে চোখে-মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন- ‘তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি? এতো টক যে!


লিচু চোর

ছোটদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন আলী আকবর সাহেব। একদিন নজরুল ইসলামকে একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত চাইলেন। পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, ‘আপনার পান্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। যদি বলেন তো আমি একটা ছড়া লিখে দিতে পারি।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন নজরুলকে একটি ছড়া লিখে দেয়ার জন্য। নজরুল ইসলামও দু’খিলি পান মুখে পুরে লিখলেন সেই বিখ্যাত ‘লিচু চোর’ কবিতাটি-



‘বাবুদের তালপুকুরে


হাবুদের ডালকুকুরে


সে-কি বাস করলো তাড়া


বলি, থাম-একটু দাঁড়া।…’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন