-->
927V0MJku1OcBLTuD7lkELe7Mk4OHfuDB8LuA1nI
Bookmark
বই রিভিউ, বই সংক্রান্ত নানান আলোচনা, সাহিত্য সমালোচনা, সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীসহ বিশ্বের আলোচিত-সমালোচিত নানান বিষয়ে Page Pleasure Books প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাঠকের জ্ঞানের জগৎ সমৃদ্ধ করাকে একটি সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করি। ‘Page Pleasure Books’ সেই দায়িত্ববোধ থেকেই নেয়া একটি প্রয়াস। বইয়ে বইয়ে সয়লাব হোক ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।

বঙ্গবন্ধুই এক গৌরবময় ইতিহাস

সবুজের ছায়াঘেরা মায়াময় হাজার হাজার গ্রামের একটি টুঙ্গিপাড়া বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজ গাছপালা, ফসলের ঢেউ খেলানো মাঠ, সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি আর ঝলমলে একটি নদী । এর নাম মধুমতী। আর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে একজন মানুষের কথা। শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সারা বাংলাদেশেরই লোক, কিন্তু জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। গ্রামের খোলা মাঠ, গাছপালা, লতাপাতা, পাখির ডাক, নদীর ঢেউ, উদার আকাশ, মাটির সোঁদা ঘ্রাণ বালক মুজিবের মনে গোড়া থেকেই দেশের জন্যে মমতা জাগিয়ে তুলেছিল।

শেখ মুজিব যখন স্কুলের ছাত্র তখন তার অজান্তেই নেতৃত্ব দেওয়ার একটা ঝোঁক দেখা যায়। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা, যা ঠিক তার পক্ষে দাঁড়ানো- এই গুণ তার স্কুল-জীবনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার বয়সের পক্ষে একটু বেশি লম্বা, উজ্জ্বল চোখ আর মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটার ভঙ্গি দেখলেই তাকে আলাদা মনে হতো। সহজেই চোখে পড়তেন তিনি।


টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটি স্কুলের বেড়া ডিঙিয়ে কলেজে পড়ার জন্যে বড় শহর কলকাতায় গেলেন, সেখানে পড়াশোনা চলতে লাগলো । কিন্তু সব সময় তিনি দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। কীসে দেশের ভালো হবে, কী হলে দেশের মানুষ সুখী হবে- এই ভাবনা তাকে ঘিরে রাখতো। তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকলেন। কারণ, একথা তার বুঝতে দেরি হলো না যে দেশের মানুষকে সুখের মুখ দেখাতে হলে রাজনীতির পথে চলতে হবে, মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে হবে দেশের জন্যে। এই কাজ করতে গিয়েই তিনি বড় বড় রাজনৈতিক নেতার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেলেন। দেখা পেলেন মজলুম নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বড়মাপের নেতার।


এই দুজন নেতার প্রচুর স্নেহ তরুণ শেখ মুজিব পেয়েছিলেন। তিনি তাঁদের কাছ থেকে রাজনীতির অনেক কিছু শিখে নেন। তবে চলমান জীবন ছিল তার সবচে বড় শিক্ষক। তিনি কোনো আরাম কেদারায় বসে চোখ বুঁজে রাজনীতি করেননি। দুচোখ খুলে পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, ক্ষেতে-খামারে ঘুরে ঘুরে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি গিয়ে দেশ ও দশের সমস্যাগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছেন। সেসব সমাধানের পথ খুঁজেছেন।


আমি জটিলতার দিকে যাব না। খুব সহজে এবং সংক্ষেপে শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের কথা বলব। হয়তো তোমরা অনেকেই জানো সেসব কথা। আবার অনেকের কিছু ঘটনা ভালো করে জানা নেই। আবছা ধারণা রয়েছে। হয়তো তোমরা শুনেছ শেখ মুজিব গোড়ার দিকে মুসলিম ছাত্রলীগে ছিলেন। তারপর মুসলিম লীগের খুব দাপটের দিনে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলো। আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে ওঠে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। এই দলে শেখ মুজিব যোগ দেন। পরে দলের সাম্প্রদায়িক গন্ধটি মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে জেগে ওঠে আওয়ামী লীগ। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে গড়ে তোলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এবার মওলানা ভাসানীর সঙ্গী হননি মুজিব। কিন্তু তিনি মওলানা ভাসানীকে সব সময় শ্রদ্ধা করেছেন, যেমন একজন সৎ শিষ্য ভক্তি করে তার গুরুকে। শেখ মুজিবের জন্যে মওলানা ভাসানীর ঘাটতি হয়নি স্নেহের ।


অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কেটেছে জনগণের নেতা শেখ মুজিবের । অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। তোমরা আফ্রিকার কালো মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। দুনিয়া জোড়া তার নাম। দেশের মানুষের জন্যে তিনি অনেক বছর সাদা চামড়ার শাসকদের জেলখানায় বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। আমাদের শেখ মুজিবও দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্যে পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বারোটি মূল্যবান বছর। পাকিস্তানি শাসকরা তাকে ফাঁসি পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।

তিনি আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পাকিস্তান-কাঁপানো আন্দোলন করেছেন দেশের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। অনেক জুলুম করেছেন, কিন্তু নুয়ে পড়েননি। সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন গৌরবের নিশান উড়িয়ে। পাকিস্তানের শাসনভার পাওয়ার কথা ছিল বাঙালিদের । কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা চক্রান্ত করে হামলা করে বসলো বাঙালিদের ওপর। হত্যা করল ত্রিশ লাখ বাঙালিকে, ইজ্জত লুটে নিল দুই লাখ নারীর।এর আগে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার ডাক। ততদিনের সামান্য নেতা, ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিব পরিচিত হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে।


পাকিস্তানের সেনাশাসকেরা শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিদের ওপর। ওরা এবং ওদের সাহায্যকারী তল্পিবাহক মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি দলের নেতা এবং চেলাচামুণ্ডারা গ্রাম পোড়ালো, শহর পোড়ালো, সাধারণ মানুষদের তো খুন করলই; অনেক অধ্যাপক, লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারকেও নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলল। এসব কথা তোমরা কী জানো? এসব নিষ্ঠুর কাজ করে ওরা কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাকে আটকে রাখতে পারেনি।

স্বাধীনতার পরেই জালিম পাকিস্তানি শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করতে বাধ্য হলো। বন্দী শেখ মুজিবের জন্যে কারাগারের পাশের উঠোনে তার কবর খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কবরে তাঁকে শোয়ানো সম্ভব হয়নি ওদের পক্ষে। তিনি নিজের দেশে নিজের মানুষদের কাছে ফিরে এলেন মাথায় গৌরবের অদৃশ্য মুকুট নিয়ে। শাসনভার গ্রহণ করলেন বাংলাদেশের। তোমাদের মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে বন্দিজীবন কাটাচ্ছিলেন, সেই ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। ভারত আমাদের সাহায্য করেছিল সত্য, কিন্তু বীরের মতো লড়াই করেছে আমাদের দেশের বিভিন্ন বয়সের মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সাহস জুগিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডাররা। সবচেয়ে বড় কথা পুরো ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলমন্ত্রের মতো কাজ করেছিল একটি নাম- শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাত্র তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পান।


বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশকে ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। নানা ধরনের অত্যন্ত কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় শেখ মুজিবকে। দেশ পরিচালনা সহজ ছিল না মোটেই। যখন তিনি মুশকিল প্রায় ঠিক করে আনছিলেন, ঠিক তখনই চক্রান্তকারীরা আঘাত হানো তার ওপর। তার দলের কিছু লোকের আপত্তিকর কাজে তিনি বিব্রত হচ্ছিলেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময় তিনি পেলেন কই? খুনিরা তাকে এবং তার পরিবারের অনেককে হত্যা করল। নারী, শিশু কেউ বাদ পড়ল না।


আজকাল অনেক চাটুকার ফায়দা লোটার মতলবে যেখানে-সেখানে ইতিহাসের মহান নায়ক শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করছে। আবার কিছু জঘন্য চরিত্রের লোক তার নামকে কালি দিয়ে লেপে দেওয়ার কাজে লেগেছে। কিন্তু কোনো লাভ নেই এতে। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, মধুমতী, সুরমা, ধলেশ্বরী, সোমেশ্বরী, সুসং, মেননং, মাইনি নদীতে জলধারা বইবে, ততোদিন কেউ শেখ মুঝিবের নাম কোনো কালি দিয়েই মুছতে পারবে না। কারণ- মহানায়কদের নাম ইতিহাসজুড়ে জ্বলজ্বল করে সব সময়। আর তিনিই এক গৌরবময় ইতিহাস।


(বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে লেখা কবি শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন