-->
927V0MJku1OcBLTuD7lkELe7Mk4OHfuDB8LuA1nI
Bookmark
বই রিভিউ, বই সংক্রান্ত নানান আলোচনা, সাহিত্য সমালোচনা, সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীসহ বিশ্বের আলোচিত-সমালোচিত নানান বিষয়ে Page Pleasure Books প্রকাশিত হয়ে থাকে। পাঠকের জ্ঞানের জগৎ সমৃদ্ধ করাকে একটি সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করি। ‘Page Pleasure Books’ সেই দায়িত্ববোধ থেকেই নেয়া একটি প্রয়াস। বইয়ে বইয়ে সয়লাব হোক ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।

জলপাইগুড়ির বাবলু থেকে সমরেশ মজুমদার

২০১৬ সাল। সমরেশ মজুমদার একদিন চোখ খুলে বুঝতে পারলেন তিনি আর কিছু পড়তে পারছেন না। তার চোখের সামনে চিকিৎসকেরা বাংলা, ইংরেজি বিভিন্ন লেখা দেখাচ্ছেন । তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। সবশেষ নার্সিংহোমের একমাত্র চিকিৎসা হয়ে দাঁড়ালো তার মুখে সারাদিন এ, বি, সি, ডি জপতে থাকা।



সমরেশ বাসায় ফিরলেন জীবনের স্মৃতিহীন এক রোগ নিয়ে। ঠিক এক সপ্তাহ পর তিনি একই রকম এক সকালে উঠে আবিষ্কার করলেন তার নিজের নাম মনে নেই। আশেপাশে খুঁজলেন, কোথাও তার নিজের নাম লেখা নেই। নাম না জানা সমরেশ বিছানায় পড়ে রইলেন ।


আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ষাটের দশকে দেশ পত্রিকা দিয়ে শুরু করেছিলেন গল্পের যাত্রা। যদিও কখনও ভাবেননি লেখক হবেন। তার প্রথম গল্পটাও মঞ্চ নাটকের উপযোগী করে লেখা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’। যদিও সেসময় তিনি ছদ্ম নাম ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ছোট কলেবরের প্রথম এই উপন্যাসেই নিজের শক্তি জানান দিয়েছিলেন তিনি।


কয়েক বছর আগে সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসেছিলেন। সম্ভবত ওটাই ছিল তার শেষ ঢাকা সফর। কে জানতো, তিনি আর কখনও ঢাকায় ফিরবেন না! তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে সৌভাগ্য হয়েছিল সেসময়ে তার কথা সামনাসামনি শোনার। এরকমই গরমের এক সকালে তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন তার জলপাইগুড়ির হাফপ্যান্ট পরা বাবলু থেকে কোলকাতার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার হয়ে ওঠার গল্প।


মন্দির ও মসজিদ থেকে আমরা শুধু গ্রহণ করতে যাই। বিনিময়ে কিছু দিতে যাই না। যদিও কিছু দিয়ে আসি, তবে তার ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যেই দেই। পৃথিবীতে মসজিদ কিংবা মন্দির ছাড়াও আরেক প্রকার একমুখী প্রাপ্তির জায়গা আছে । সেটা হলো লাইব্রেরি কিংবা বইয়ের দোকান। এই অসাধারণ কথাটাও আমি সমরেশ থেকে শুনেছিলাম সেদিন।


এতসব গভীর কথাবার্তার মাঝে কিছু সাধারণ তথ্য পেয়েছিলাম যা আমার কাছে বেশ ‘ইন্টারেস্টিং’ লাগলো। তিনি কখনই আত্মজীবনী লেখার পক্ষে নন। কারণ এতে নাকি শত্রুই বাড়ে। ‘যারা এতদিন ভাবতো এই কাজটা আমি অমুক কারণে করেছিলাম। কিন্তু আত্মজীবনীর পর তারা জেনে যায় আসলে কাজটা করেছিলাম অন্য কারণে’। তাই সমরেশের মতে, আত্মজীবনীর একমাত্র পাঠক থাকা উচিত সে নিজেই। আরো জেনেছিলাম, সমরেশ মজুমদার তার লেখার সময় প্রতি পাতায় একদম গুনে গুনে ৩৫ লাইন লেখেন । আর প্রতি লাইনে থাকে ১২ টি করে শব্দ । এটা নাকি তার জীবনে এতটাই ছাপ ফেলেছে যে, অনেক চেষ্টা করেও তিনি এই অভ্যেস বদলাতে পারেননি। সাথে সাথে জানলাম তার সবচেয়ে পছন্দের ব্যক্তিত্ব হলো বিমল ধর । তার সবচেয়ে পছন্দের ছোটগল্প হলো ‘টোপ’।


ব্যক্তিগত জীবনে সৎ থাকার একটা গল্প আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি একবার অকাদেমি পুরস্কারের উসিলায় বিশাল টাকা পেলেন। তখন তার চাকরি না করলে ও চলে। চারিদিকে তার কদর। একদিন দেরি করে অফিসে গিয়ে দেখলেন সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলেন কোনো কারণে কমবেশি সবাই দেরি করে এসেছে। কিন্তু বড়বাবুর ভয়ে কেউ ঢুকতে চাইছে না। যেহেতু সমরেশ এখন বিখ্যাত সাহিত্যিক। তাই তাকে সঙ্গে করে প্রবেশ করলে হয়ত রক্ষে মিলবে। সমরেশ সবাইকে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন ঠিকই কিন্তু সেদিনই চাকরি ছেড়ে দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন। এরকম খ্যাতির আশা তিনি করেন না।


সমরেশ মজুমদারের লেখায় সেসময়কার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উঠে এসেছে প্রত্যক্ষভাবে। প্রথম বইতেই তথাকথিত ‘পলিটিক্স’ করার দায়ে চাকরিচ্যুত হন গল্পের প্রধান চরিত্র রাকেশ। সেখানেই তিনি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় পরিচিত হোন কোলকাতার এক বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক সমাজের সঙ্গে। এছাড়াও পরবর্তীতে তাঁর লেখা বিখ্যাত বইগুলোতে রাজনীতি ও বিশেষ করে নকশাল আন্দোলনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপস্থিতি পাওয়া যায়।


বাংলাদেশে প্রায় দুই থেকে তিন দশক তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। তার বিখ্যাত ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ বইগুলো আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। সেগুলোর গল্পগুলো কেন আমাদের ছুঁয়ে গেছে? গল্পগুলো তো আমাদেরই। ট্রিলজির প্রথম বেরিয়েছিলো উত্তরাধিকার। এই উপন্যাসের কাহিনি চা বাগান থেকে শুরু, যেখানে অনিমেষের শৈশব কাটে। এ যেন আমাদের দেশেরই সিলেটের কোনো চা বাগানের পাশে বেড়ে ওঠা অনিমেষের গল্প। সেই অনিমেষের নাম হয়তোবা ভিন্ন। সমরেশ মজুমদার এজন্যই বলেছিলেন, ‘সিলেটের চা বাগান আমাকে খুব করে টানে। এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠলে কোলকাতা আর বাংলাদেশের চা বাগানের কোন পার্থক্য পাই না’। সমরেশের বিখ্যাত ট্রিলজির প্রথম উপন্যাসই যেন বাংলাদেশের গল্প বলে। অখণ্ড ভারতে চলা একটি সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থান পতনের গল্প বলেছে উত্তরাধিকার বইটি। জাতি হিসেবে যা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিংবা সাতকাহন বইটির দীপাবলি নামের মেয়েটার গল্প আমাদের স্পর্শ করে। কেন দীপাবলীর মতো এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এলো এ প্রশ্নের উত্তরে সমরেশ বলেছিলেন, “আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি’।


সমরেশ বাংলাদেশকে কাছের মনে করেছেন বাস্তবিকভাবেই। তিনি বরাবরই স্পষ্ট ভাষার মানুষ। কিছুদিন আগেও সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের রাজধানী বাংলাদেশ। সমরেশকে আমরা আরো পেয়েছি সিনেমায়। গৌতম ঘোষের পরিচালনায় কালবেলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলা ভাষার সিনেমা কখনই আমরা দু’ভাগ করতে পারেনি। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা বইটি আশির দশকে বের হলেও তারপরেও প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। অবশ্য এখন যে আর জনপ্রিয় নেই, সেটা বললেও বড় ধরনের ভুল বলা হবে।


সমরেশ মজুমদারের বিশাল লেখালেখির জীবনের ইতি ঘটলো গত ০৮ মেয়ে সন্ধ্যা বেলায়। করোনার মত মহামারিতেও বেঁচে ফেরা সমরেশ যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে একরকম হুট করেই চলে যাবেন, তা কে জানতো। তিনি বলতেন মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেলেও তার কাছে কোলকাতার আকাশটা একই লাগে। সেই তরুণ বয়সী সমরেশ যখন আকাশের দিকে তাকাতেন, ঠিক যেই আকাশটা দেখতেন এখনও কোলকাতায় সেই আকাশই আছে। আজ সকালেও সেই আকাশটা আলো ছড়িয়েছে বটে, তবে চিরতরে নিভে গেছে সমরেশ মজুমদারের প্রাণ পিদিম। তার মায়াময় এক গল্প দিয়ে এই লেখাটা শেষ করছি।


জলপাইগুড়ি চা বাগানে বড় হওয়া বাবলুই কিন্তু আজকের সমরেশ। বাবলুরা তখন সবে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট পড়তে শিখেছে। চা বাগান পেরিয়ে গাছের বিশালাকার ছায়া দিয়ে ঢাকা পাঠে বাবলু সহ পাড়ার অনেকেই তখন ফুটবল খেলতো। তাদের খেলা তেমন কেউ দেখতো না। তবে নিয়মিত খেলা দেখতে আসতো একটা এগারো বারো বছরের নিতান্তই বালিকা। পিঠে তার ঝুলে থাকা একটা শিশু। বাগানে কাজ করা মহিলারা যেভাবে নিজের সন্তানকে পেছনে ঝুলিয়ে রাখে ঠিক সেরকম। তার ভাই হবে হয়ত। বালিকার নাম এতোয়ারি। তো এতোয়ারির চোখের উপর কেমন ফোলা ফোলা। সম্ভবত টিউমার হবে। এছাড়া দেখার মত কোন বিশেষত্ব নেই মুখে। মাঝেমধ্যেই খেলার মাঝে তাকে নাম ধরে বাবলু কিংবা অন্যরা ডাকতো। সে কোন রা করতো না। তার সাথে দেখা হতো একমাত্র খেলার সময় ।


পঞ্চাশ বছর পর সমরেশ মজুমদার গেছেন জলপাইগুরিতে। তার বুড়ো হয়ে যাওয়া মাসীরা বললেন, এতোয়ারীর সাথে দেখা করবি? সমরেশ তো অবাক। এখনো বেঁচে আছে বুঝি! ডাকো তাকে। পঞ্চাশ বছর আগের বালিকা এতোয়ারীর চোখে এখন আর ফোলা নেই। পিঠে তার ঝোলা নেই । সমরেশ বললেন, ‘কিরে আমাকে চিনিস?’ অতোয়ারী জানে না বিখ্যাত লেখক তার সামনে দাঁড়িয়ে । সে এক ঝটকায় বললো, ‘এ তো বাবলু’। সমরেশ মজুমদার মজা করে বললেন, ‘তোর বাবা না হারিয়া খেতো? তুই বানিয়ে দিতি আমি জানি। আমাকে হারিয়া খাওয়াবি?’ হারিয়া হলো বাংলা মদ । অতোয়ারী ছি ছি ছি করে চলে গেলো তক্ষুনি।


বিকেলে চলে যাবার জন্য তৈরি হয়ে গাড়ির দিকে গিয়ে দেখলেন অতোয়ারী দাঁড়িয়ে। সমরেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘কিরে এখানে যে?’ অতোয়ারী তার আচলের নীচ থেকে একটা বোতল বের করে বললো, ‘নে হারিয়া । তুই না খেতে চেয়েছিলি? এক্ষুনি বানিয়ে এনেছি। তোর যা বয়স, কম করে খাস কেমন!’


সেই মায়াময়ী আর অতোয়ারীর গল্প নিয়ে সমরেশ মজুমদার আর ফিরবেন না, এর কোন মানে হয়?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন